একটু আলাদা

রোজকার মত ফোনের অ্যালার্মটা বেজে উঠল ঠিক ৬:৩০ এ। আমিও প্রত্যেক দিনের মতন ফোনটা বন্ধ করে, পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। একা থাকার এটা একটা ভারী বড় সমস্যা , প্রত্যেক দিন অফিসের জন্য দেরি হয়ে যায়।

ভেজা চুল, কোঁচকানো শার্ট যেটা আয়রন করে রাখা উচিত ছিল, আর সঙ্গে গ্যাসে রাখা ডিম পোচ যেটা আর খাওয়ার অবস্থায় নেই। দিল্লিতে আসার পর এটাই আমার রোজকার রুটিন হয়ে উঠেছে।

আজ প্রায় ২ মাস হল; দিল্লিতে আমার আসা ৬ মাসের ইন্টার্নশিপের জন্য। একটা নিউজপেপারের অফিসে ফোটো জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করছি। এই নিয়ে এক মজার কথা মনে পড়ল। ছোটোবেলায় যখন ক্লাসে আলোচনা চলছে সবাই বড় হয়ে কী হতে চাই; কেউ বলে ডক্টর বা কেউ বলে ইঞ্জিনিয়ার। খুব আলাদা হলে কেউ কেউ টিচার বলে, এই সব কিছুর মাঝে আমি সেদিন খেলার ছলে বলেছিলাম ফটোগ্রাফার হতে চাই। ক্লাসের সব চোখ আমার দিকে। অদ্ভুত লাগছিল কিন্তু এর আগে বা এরপর ওরকম অ্যাটেনশন কোনো দিনও পাইনি।

দিল্লির মেট্রো স্টেশনের লাইনের মতন আমার জীবনেও অনেক রং পাল্টেছে। শুরু দিকে এক চেনা পরিচিতের কাছে থাকছিলাম কিন্তু এখানে মানুষের মন বড় হলেও স্পেস ক্রাঞ্চ এর সমস্যা এড়ানো যায় না। 

সবার সুবিধা হবে এই ভেবেই এক বন্ধুর সঙ্গে রুম শেরিং করার দিকে এগিয়ে গেলাম। বন্ধুর নাম রাহুল, গত এক সপ্তাহ থেকে নিজের বাড়িতেই আছে, ২-৩ দিনের পর ফিরে আসবে হয়ত। রান্না করাটা কতটা  ধৈর্যের আর সিস্টেমেটিক প্রসেস এই কিছু  দিনে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি। সময়ের সঙ্গে হয়ত এটাও একদিন শিখে নেওয়া যাবে।

সেদিন অফিসে যেতেই আমার চোখ আরিফের দিকে যায়, ওর মন আর মেজাজ দুটোই ভালো নেই দেখলাম। আরিফ আমার টিমমেট , আমরা এক সঙ্গে "Delhi untold stories" এই কলমের জন্য কাজ করছি।
আরিফের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম টিম হেড জানিয়েছেন আমাদের কারেন্ট স্টোরি কভারটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। হয়ত এই সমাজে আবর্জনা সংগ্রহকারীদের গল্পগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া যায় না। 
"কেশভ কুমার" এই  নামটা হয়ত কেউ জানে না , মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে কাজ করা এক সাধারণ কর্মী, কিন্তু একটু আলাদা ভাবনা চিন্তা।

ওনার কাজ শুধু রাস্তার আবর্জনাগুলোকে এক পাশে করে, পরিস্কার করা। কিন্তু এই কাজের মধ্যেও কিছু ভালো করার ভাবনা রেখেছিলেন। উনি প্রত্যেক দিনের আবর্জনা থেকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক আলাদা করে নিজের মত ব্যবহার করতেন, গাছ লাগানোর জন্য। কেশভ কুমারের বাড়ি কোন এক অন্ধকার গলির রাস্তায় পড়ে। কিন্তু পথ শেষে এক সবুজ পৃথিবীর জগৎ আছে। 

নিজের কাজকে ভালোবাসলে কি না করা যায়, উনি এটারই এক চমৎকার উদাহরণ। আজ হয়ত কেশভ কুমার আমাদের নিউজপেপারের এক কোণায় নিজের যায়গাটা গড়ে তুলতে পারলেন না, কিন্তু এই পরিবেশকে সাথে নিয়ে চলার চেষ্টা ওনাকে অনেকের থেকে আলাদা করে দেয়।

-  শতরূপা উপাধ্যায়



Post a Comment

3 Comments