লাল পেনের কালিটা ঠিক এই সময় শেষ হতে হল, কাজটা শেষ করব কী করে এবার? থাক, না হয় বাকি কাজ কাল করব।
দেখতে দেখতে রাত ১১টা বাজতে চলল, যাই এবার জল খেয়ে শুয়ে পড়ি, কাল আবার সকাল সকাল বেরোতে হবে।
মিসেস দাশগুপ্ত এই ভেবে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। চারিদিকে এত শান্তি, যে বাইরের ঝিঁঝিপোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
রান্নাঘরের আলোটা নিভিয়ে যখন মিসেস দাশগুপ্ত চলে যাবার পথে, ঠিক তখনই ওপরের ফ্ল্যাট থেকে কেউ একজন জোরে চিৎকার করে উঠল। ফেরত এসে জানালাটা খুলে দাঁড়াতেই আওয়াজগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
"সেই সকাল থেকে একই জিনিস পড়ানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই তোমার পড়াশুনায় মন বসছে না।"
তাতাই কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল, "মা, সকালে প্রশ্নগুলোর উত্তর আলাদা ছিল আর বিকেলে এই প্রশ্নগুলোই পাল্টে গেল, আমি তো এর উত্তর জানি না"
"শুধু মুখে মুখে তর্ক, দিন দিন এত খারাপ রেজাল্ট হচ্ছে সেটা ঠিক করার চেষ্টা বা আগ্রহ কোনোটাই নেই।"
"মা আমি তো..."
রান্নাঘরের আলোটা নিভিয়ে মিসেস দাশগুপ্ত নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ওনার চোখে একটু চিন্তা আর অবাক হয়ে যাওয়ার ভাব।
এই ঘটনার এক মাস পর তাতাইয়ের স্কুলে অভিভাবক আর শিক্ষকদের বৈঠক ছিল।
কিছু খুনসুটি, কিছু বাড়িতে না বলা নম্বর আর কিছু প্রশংসা এই সব ঘিরে ছিল ক্লাস সেভেনের আমেজ।
শুরু হল রোল নম্বর ধরে এক এক করে খাতা দেওয়া।
কেউ ইতিহাসে ভালো , অন্য কেউ আবার জীবনবিজ্ঞান । অনেকের আবার পদার্থবিদ্যা আর অঙ্কের মধ্যে কোনো মিল নেই। বলাটা হয়ত একটু কঠিন, কিন্তু লিখতে ভালই পারে ইংরেজি। বাংলায় বানান একটু গোলমাল আছে...।
এই সমস্ত জিনিস আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল, তখনই শ্রেণিশিক্ষক এসে অ্যাটেনশনটা একটু নিজের দিকে নিলেন, হাতে ছিল চক আর ডাস্টার।
"নম্বরের ভিত্তিতে তো অনেকটাই মাপঝোপ করলেন। এবার কিছু অজানা উত্তরে ফিরে আসা যাক।
আচ্ছা মিস্টার রয়, আপনি রান্না করতে তো বেশ ভালোবাসেন। ধরুন যদি কোনো একটা নতুন খাবারের নাম বলা হল, আপনি কি সেটা বানাতে পারবেন?"
"চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে, তবে রান্নার পদ্ধতিটা বলে দিতে হবে।"
"বেশ, আর মিসেস সেন আপনি নিজে একা গাড়ি চালিয়ে জিপিএস ম্যাপ ছাড়া কোনো নতুন জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন? জায়গার নামটা যদিও বলা থাকবে।
"এ কি বলছেন ম্যাডাম রাস্তা অজানা থাকলে শেষ পর্যন্ত কি যাওয়া যায়?"
"বেশ তাহলে মানছেন তো কোনো কিছুর কার্যধারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ শেষের ফলটা পাওয়ার জন্য?
আজকে তাহলে আমাদের সবার টেক হোম মেসেজ হল শেষের উত্তরটা পাওয়ার জন্য শূন্য থেকে শুরু করবো, আর প্রসেসে মনোযোগটা বেশি দেওয়ার চেষ্টা রাখবো।"
সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাতাইয়ের মা ফ্ল্যাট নম্বর 3B তে গিয়ে কলিং বেলটা দিলেন। মিসেস দাশগুপ্ত বেরিয়ে এলেন। উনি একাই থাকেন।
"ম্যাডাম আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্যে আসা। আজকে আপনি যদি স্কুলে না বোঝাতেন তাহলে হয়ত জীবনের প্রত্যেকটা স্টেপ ভুল হত। এবার আসি। ভুলগুলো শুধরে নেব।"
কী বুঝলেন তাহলে? মিসেস দাশগুপ্ত শুধু মাত্র তাতাইয়ের প্রতিবেশী না। উনি তো ওর ক্লাসের শ্রেণিশিক্ষকও।
- শতরূপা উপাধ্যায়
2 Comments
অপূর্ব বন্ধু ❣️
ReplyDeleteঅসাধারণ একটা ভাবনা নিয়ে এই লেখা। খুব ভালো লাগলো আমার। ভীষণ শিক্ষণীয় একটা।
ReplyDelete