হটাৎ

পুরো বিশ্ব জুড়ে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা দ্বিগুণ গতিতে বেড়ে চলেছে।


দিনটা ছিল ২৪ মার্চ ২০২০, টিভিতে সেদিন বিকেলের খবরের হেডলাইন কিছুটা এমনই ছিল।


মিস্টার দাস যদিও বা টিভির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, মিসেস দাসের চোখ দুটো দরজায় আটকে ছিল; ওনার এক মাত্র ভাইঝি কাকুলির অপেক্ষায়।


কাকুলির রাঁচি আসার কারণ হল খবরের কাগজের সূত্রে পাওয়া এক ইন্টারভিউয়ের সুযোগ।


একটি প্রাইভেট স্কুলে আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট ডিপার্টমেন্টে একটি শিক্ষিকার স্থান খালি রয়েছে, নিজের দক্ষতা হিসেবে কাকুলির এই কাজটা যুক্তিপূর্ণ মনে হয়েছিল। এই সুযোগ কোনো ভাবেই হাতছাড়া করতে চায়নি সে, তাই ইন্টারভিউয়ের ৪ দিন আগেই কাকুলি হাজির হয়েছিল রাঁচিতে।


ঘড়ির কাঁটা বলছে তখন সন্ধে ৭ টা, দরজায় কেউ বেল দিল, হ্যাঁ ওটা কাকুলি এসেছে। মিসেস দাসের মনে শান্তির ভাবনার সৃষ্টি হল।


"কীরে এত দেরি কেন হল? রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?" মিসেস দাস কৌতূহলসহ জিজ্ঞেস করলেন।


"বাস স্টপে খুব ভিড় আজ। তাই ২ ঘণ্টা দেরি হল", উত্তরটা প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে দিল কাকুলি।


ঠিক এই সময় বাড়ির কারেন্টটা চলে গেল। 


"উফফ আর পারা যায় না কারেন্টটাকেও এখনই যেতে হল! যাই রান্নাঘরে দেখি মোমবাতিটা কোথায় রাখলাম", এই বলে মিসেস দাস রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।


"আরে চিন্তার কোনো ব্যাপার না। আমাদের একার না, গোটা পাড়ার কারেন্ট চলে গেছে", এই বলে নিজের মনকে কিছুটা হলেও একটু সান্তনা দিলেন মিস্টার দাস।


এক হাতে মোমবাতি, আরেক হাতে জল বাতাসার প্লেটটা নিয়ে এলেন মিসেস দাস, নিজের ভাইঝির জন্যে।


এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের জল শেষ করে, কিছুটা হলেও ওই গরম আবহাওয়ার আমেজটা একটু কাটিয়ে উঠল কাকুলি।


এরপর পালা এল প্রশ্ন উত্তরের, পিসেমশাই জিজ্ঞেস করলেন "কাকুলি ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিস তো ঠিকঠাক? যদিও তোর ওপর ভরসা আছে, তুই ঠিক কোয়ালিফাই করে যাবি দেখিস।"


"হাঁ চেষ্টা করছি যাতে পরিণামটা মনোমত হয়" মধ্যম স্বরে কাকুলি বলল।


হঠাৎ করে একটা কাচের বয়াম ভাঙার আওয়াজ, সবাই পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে; রাতুল দাড়িয়ে আছে। রাতুল মিস্টার ও মিসেস দাসের ৯ বছরের ছেলে।


"দিলি তো ভেঙে ওটা? সত্যি তোকে নিয়ে আর পারা যায় না, এক জায়গায় স্থির হয়ে বসলেও তো পারিস"– মিসেস দাস বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন।


"আহা! আর চিৎকার করে কি কোনো লাভ আছে? এই রাতুল যতক্ষণ না কারেন্ট আসছে, এখানে এসে চুপচাপ বস তো দেখি" মিস্টার দাস পরিস্থিতিটা কে সামলানোর চেষ্টায় বললেন।


সময় গড়িয়ে তখন প্রায় ৮ টা বাজে, কারেন্ট এল।

পাশের বাড়ির অন্তক্ষারি খেলা বন্ধ হল, অন্ধকারে সময়টা যেখানে থেমে ছিল, সেখানেই আবার ফিরে গেল এমনটাই অনুভূতি হল সবার।


কারেন্ট আসাতে যেমন লাইট, ফ্যান সব চলতে শুরু করল, যেহেতু টিভির সুইচটা দেওয়া ছিল, ওটাও চলতে শুরু হল।


টিভির পর্দায় খবর শুনে; দুশ্চিন্তা, হতাশা এবং আরো অবাক হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকিয়ে একে ওপরের দিকে, কাকুলি আর মিস্টার ও মিসেস দাস।


করোনার পরিস্থিতি দেখে কেন্দ্রীয় সরকার ২১ দিনের লকডাউনের ঘোষণা করেছে।


ঠিক এই সময় রাতুল কিছু না ভুঝেই বলে উঠল, "মা তাহলে আমার স্কুলের কিছু দিন ছুটি তো? আমি যাই একটু তাতাইয়ের সঙ্গে ক্রিকেট খেলে আসি ছাদ থেকে, হোমটাস্কটা কাল করে নেব।"


রাতুল তো নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়ল। 


এদিকে মিস্টার ও মিসেস দাস নানা রকমের চিন্তায়– বাড়ির মাসকাবারি, রাতুলের পড়াশোনা, খাবারের দোকানের ব্যবসা যেটা তাদের একমাত্র রোজগারের সূত্র।


অন্যদিকে কাকুলি ভাবছিল এই পরিস্থিতিতে ইন্টারভিউ হওয়াটা সত্যি অসম্ভব। তার ওপর আবার আত্মীয়ের বাড়িতে ঘরবন্দী।


আলোতেও অন্ধকার জড়িয়ে পড়ল সবার মনে।


- শতরূপা উপাধ্যায়

Post a Comment

1 Comments