লুকোচুরি


 পুরো ঘর তখন নিস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত একটা, জানালা দিয়ে বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। ঝিলমিল স্টাডি টেবিলে বসে নিজের সব মনের কথা আমাকে বলছে। আমার সঙ্গে ওর বেশ পুরোনো বন্ধুত্ব। ওর ভালো লাগা, খারাপ লাগা, রাগ, দোষ সব আমার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে।

আমি কে এটাই ভাবছেন তো? আমি ঝিলমিলের ডায়েরি।

চলুন দেখে আসি আজ ঝিলমিল নিজের কোন মনের কথা আমাকে গোপন করতে চলেছে।

04/07/2010,
আজ একেবারে ধরা পরে গেলাম নীলের কাছে...

ঝিলমিলের আজকের দিনটা আসার জন্য আমার একটু প্রশংসা আপনাদের করতেই হবে। আপনারা এটাই ভাবছেন তো যে এই নীলটা কে? এটা জানার জন্য পাতা উল্টে এক মাস আগে যাওয়া যাক।

02/06/2010,
ফুটপাত ধরে কলেজ থেকে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাছিলো ঝিলমিল, হাতে একটা চিপসের প্যাকেট। চিপসটা সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল, তাই রাস্তার ধারে এক কোণায় প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই পেছন থেকে কেউ আওয়াজ দিল:

- এই যে ম্যাডাম শুনছেন, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি।

পেছন ঘুরে তাকিয়ে দাঁড়ানো মাত্র ঝিলমিল দেখল, একটি ছেলে হাতে ওই চিপসের প্যাকেটটা নিয়ে এগিয়ে আসছে।

- আপনাকে দেখে তো সুস্থ আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

- মানে , কী বলতে চান? একটু রেগে গেয়ে বলল ঝিলমিল।

- মানে এটাই যে এই চিপসের প্যাকেটটা দু পা এগিয়ে গেয়ে ওই ডাস্টবিনটাতে ফেললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত আপনার?

ঝিলমিলের কিছু বলে ওঠার আগেই ছেলেটা সামনের ডাস্টবিনে চিপসের প্যাকেটটা ফেলে এগিয়ে গেল...

এটাই ঝিলমিল আর নীলের প্রথম দেখা। ঝিলমিল মনে মনে নিজের ভুলটা স্বীকার করে নিয়েছিল।

05/06/2010,
কলেজে ছাত্রছাত্রীদের বেশ ভিড়, পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে গাছের চারা লাগানো হচ্ছে।

- কীরে ঝিলমিল দেখছিস তো মনে হচ্ছে আজকে পুরো কলেজের নকশাটাই পাল্টে যাবে, যে ভাবে এরা পরিষ্কার করছে আর গাছ লাগাচ্ছে, কিন্তু আদেও কি এইগুলো বজায় রাখা যাবে? নাকি পুরো বছরে এই একটা দিনই সব নামমাত্র।

পিউর কথা শুনে ঝিলমিল বলে উঠল:

- কিছু কিছু মানুষ আছে যারা পরিবেশটাকে আপন করে রাখতে জানে শুধু আজ না, প্রত্যেকটা দিন।

ঝিলমিলের খামখেয়ালী কথাগুলো পিউ কিছুই বুঝতে পারল না। ঝিলমিল এক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকিয়ে...

09/06/2010,
প্রাই এক সপ্তাহে হয়ে গেল, এই কদিনে ঝিলমিল নীলের ব্যাপারে অনেকটাই জানতে পেরেছে। নীল কলেজের "গ্রীন অ্যান্ড ক্লিন" কমিটির হেড আর লাইফ সাইন্স ডিপার্টমেন্টের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।

27/06/2010,
এর পর ঝিলমিলের নীলের সঙ্গে প্রায় কলেজ চত্বরে দেখা হয়েছে। কখনো কলেজ ক্যান্টিন বা কখনো কলেজের কালচারাল অনুষ্ঠানে, অনেক সময় বাড়ি ফেরার পথেও।

নীল নিজের প্রথম দিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিল। নিজের সেদিনের কথা থেকে না সরে বলেছিল যে ওর ওইভাবে উত্তেজিত হয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।

নীল ঝিলমিলের মনে বেশ পাকাপাকি ভাবে নিজের যায়গাটা বানিয়ে ফেলেছে এটা বুঝতে অন্তত ঝিলমিলের কোনো সন্দেহ ছিল না।

30/06/2010,
জুন মাস শেষ হতে চলল, বর্ষা যে কোনো সময় নামল বলে, আকাশে বেশ কালো ঘন মেঘ ভেসে আসছে। 

কিন্তু ঝিলমিল এখনও নিজের মনের কথা নীলকে বলে উঠতে পারেনি, যদিও আমার গত এক মাসের প্রত্যেকটি পাতায় কম করে হলেও সাত-আট বার নীলের নাম হবে। অন্য দিকে কলেজ শেষ হতে চলেছে, এর পর আদেও কোনো দিন দেখা হবে নীলের সঙ্গে তার কোনো ঠিক নেই।

02/07/2010,
কলেজের লাইব্রেরীতে বই ফেরত দিতে এসেছে ঝিলমিল আর পিউ। 

আজ ঝিলমিল বাড়ি থেকেই সংকল্প করে এসেছে, যে করেই হোক না কেনো নীল কে নিজের মনের কথাগুলো বলবে আজকেই, যদিও কলেজ শেষ হচ্ছে কিন্তু এই শহর, রাস্তাঘাট সব তো এক থাকবে।

পিউ হঠাৎ করে উত্তেজনার সঙ্গে বলে উঠলো :

- জানিস ঝিলমিল ওই লাইফ সাইন্স ডিপার্টমেন্টের নীল বোলে একটা ছেলে আছে বিদেশে মাস্টার্স করার সুযোগ পেয়েছে, দারুণ ব্যাপার বল!

পিউর কথা শেষ হতে না হতে ঝিলমিল হতাশার সঙ্গে তাড়াহুড়োতে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে পড়ল আর পেছোনে ফেলে গেল আমাকে টেবিলের এক কোণায়।

04/07/2010,
আজ সকালবেলার ঘটনা;

নীলের দুরে চলে যাওয়ার দুঃখে, ঝিলমিল একটুও টের পাইনি যে আমি ওর প্রাণের থেকেও প্রিয় বন্ধু ওর কাছে নেই।

পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ডটা নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঝিলমিল, তখনি পেছন থেকে একটা বেশ পরিচিত ডাক এসে থমকে দিল ঝিলমিলকে।

- এই যে ম্যাডাম শুনছেন, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। 
ঝিলমিল পেছন ঘুরে তাকাল , নীল ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

- আপনি কিন্তু ধরা পড়ে গেছেন, আর এই হল তার প্রমাণ। 
এটা বলে নীল আমাকে ঝিলমিলের দিকে এগিয়ে দেয়।

এর পর নীল ঝিলমিলকে সবটাই খুলে বলে; কীভাবে সেদিন ঝিলমিলের লাইব্রেরী থেকে চলে যাওয়ার পর, আমি নীলের হাতে এসে পরি, আর শেষ থেকে একটার পর একটা পাতা উল্টে সবটাই জেনে ফেলেছে নীল। এখন ব্যাপারটা নীল আর ঝিলমিলের কাছে পুরোটাই স্পষ্ট।

যাওয়ার আগে নীল আমাকে ঝিলমিলের হাতে তুলে দিতে দিতে বলে গেল:

- আমি জানি আমরা দুজন আলাদা দুটো দেশে থাকবো, কিন্তু চাইলে এর মাঝখানে একটা নো ম্যানস ল্যান্ড বানানো যেতেই পারে, একটু ভেবে দেখতে পার, আমার ইমেল আইডি আর নতুন ফোন নম্বরটা পাঁচই জুনের পাতায় লেখা আছে।

05/07/2010,
আজ সকালে পিউ এসেছে ঝিলমিলকে নিয়ে একসঙ্গে পরীক্ষা দিতে যাবে।

পিউ ঘরে ঢুকতেই বলে উঠল:

- কীরে ঝিলমিল তোর ঘরটা তো দেখছি বেশ ছিমছাম; আগে তো এরম কখনো দেখিনি। তোর জিনিসপত্র তো সব এলোমেলো হয়ে রাখা থাকত।

ঝিলমিল পাঁচই জুনের পাতাটার দিকে তাকিয়ে বলল:

যেখানের জিনিস সেখানে রাখার স্বভাবটা কারোর ধার দেওয়া, সহজে আর পাল্টানো যাবে না।

- শতরূপা উপাধ্যায়

Post a Comment

0 Comments